রণ উত্তেজনা থেকে রণাঙ্গন। টানা দুসপ্তাহের থমথমে সীমান্ত এখন যুদ্ধতাণ্ডবে উন্মাদ। মাথার উপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে উড়ছে ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্র-যুদ্ধবিমানের ঝাঁক। থেমে থেমেই বিকট শব্দ-আছড়ে পড়ার শব্দ; ভেঙেচুরে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার শব্দ! পরক্ষণেই আবার নিরাপদে আশ্রয়ে ছোটার সাইরেন! মুহূর্তেই ব্ল্যাকআউট। সীমান্তের শত শত মাইলজুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশে আগুনের ঝলকানি! ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলায় ২৬ জন নিহতের পর থেকে ভয়ংকর এই দৃশ্যগুলোই নিয়মিত হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরাক্রমশালী রাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত ৯টার ঠিক আগ মুহূর্তে আবার সেই আতঙ্কই ফুটে উঠল ভারতশাসিত জম্ম-কাশ্মীরে। পরপর বিস্ফোরণে হঠাৎ কেঁপে ওঠে জম্মু। আখনুর, সাম্বারে বেজে ওঠে সাইরেন। পাকিস্তানের দিকে এলওসির ওপার থেকে উড়ে আসে একাধিক রকেট। সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ ‘ব্ল্যাকআউট’ করে দেওয়া হয় পুরো এলাকা। ভারতের সেনাবাহিনী বলছে, মোট আটটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে তারা। হামলার নিশানায় ছিল মূলত জম্মু বিমানবন্দর, সাম্বা, আরএস পুরা, আরিনা এবং সংলগ্ন এলাকা। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ দিয়ে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আটকানো হয়েছে। নওসেরায় জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেও দুটি পাকিস্তানি ড্রোন গুলি করে নামানো হয়েছে। পালটা জবাবে লাহোর, শিয়ালকোটে হামলা চালায় ভারত। রাজস্থান, পাঞ্জাব, পাঠানকোন, উরি, উধমপুরেও হামলার সাইরেন বাজতেই ব্ল্যাকআউট করে ফেলা হয়। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে দিল্লি গেটের। টাইমস অব ইন্ডিয়া, বিবিসি, এনডিটিভি।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জম্মুতে বৃহস্পতিবার একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ভারতের সেনা সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তানের ড্রোন হামলায় এসব বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে তারা সন্দেহ করছে। রাতে সাইরেন বাজার পাশাপাশি জম্মুর আকাশে লাল শিখা ও ‘প্রজেক্টাইল’ দেখা গেছে। নাম গোপন রাখার শর্তে বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে ভারতীয় এক সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, জম্মুর বেশ কয়েক জায়গা এবং পাশের শহর আখনুর, সাম্বা ও কাঠুয়ায় হামলা হয়েছে। ‘আমাদের সেনা স্থাপনাগুলো আক্রমণের মুখে পড়েছে। জম্মুর পাঁচ জেলায় এটা ঘটছে,’ বলেছেন ভারতীয় একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক্সে জানিয়েছে, ‘পাঠানকোট, জম্মু, উধমপুরে সেনাঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। সেই হামলা প্রতিহত করা হয়েছে। কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ভারত নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রস্তুত।’ এনডিটিভি জানায়, সঙ্গে সঙ্গেই জম্মু ও কাশ্মীরের সব সেনাঘাঁটিতে আলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এলওসি থেকে দুই মাইল দূরের উরি সেক্টরেও ক্রমাগত ধেয়ে আসে মর্টার। রাজৌরিতে পরপর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। পাকিস্তানের ছোড়া বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র নিষ্ক্রিয় করেছে সেনাবাহিনী।’ রাজস্থানের ফালোড়ি বিমান ঘাঁটির ২০ কিলোমিটার দূরে একটি পাকিস্তানি ড্রোন গুলি করে নামিয়েছে ভারতীয় সেনা। পুরো বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গেই জানানো হয় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল তাকে ফোন করে অবহিত করেন।
তবে জম্মু, পাঠানকোট, রাজস্থানের জয়সালমারসহ ভারত সীমান্তে হামলার ভারতীয় গণমাধ্যমের ভিত্তিহীন অভিযোগ অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। রাতেই এক বিবৃতিতে নতুন এ ‘হামলা কাহিনী’ বানোয়াট ও রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দেয় দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর।
দুদেশের চলমান এ উত্তেজনা নিরসনে বৃহস্পতিবার রাতের ‘ব্ল্যাকআইট-সাইরেন’ হাওয়ার মাঝেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে ফোন করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, ফোনালাপে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার প্রশমনের বার্তাই দেন রুবিও।
বৃহস্পতিবার ভোররাতে পাকিস্তান ও আজাদ কাশ্মীরের মোট ৯ স্থানে হামলা চালায় ভারত। তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বলেছে, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ছোড়া অন্তত ২৯টি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার মধ্যরাতে পাকিস্তানের ছয় শহরের ৯ লক্ষ্যবস্তুর ২১ স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে ভারতের সামরিক বাহিনী। ভারতের এই হামলার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। কিন্তু তার এ হুমকির মাঝেই দেশটিতে আবারও ড্রোন হামলা চালিয়েছে ভারতীয় বাহিনী। রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র আহমেদ শরীফ চৌধুরী এএফপিকে বলেছেন, ভারত আবারও একাধিক স্থানে ড্রোন পাঠিয়ে আরও একটি আগ্রাসনের কাজ করেছে। ভারতের ছোড়া একটি ড্রোন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর এই সদর দপ্তরের কাছে ভূপাতিত করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। আরও বলেছেন, লাহোরের কাছে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ভারতীয় একটি ড্রোন আঘাত করেছে। এতে সেখানে অন্তত চার সেনা আহত হয়েছেন। ভারতীয় ড্রোনের আঘাতে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের সিন্ধুতে এক বেসামরিক নিহত ও আরেকজন আহত হয়েছেন। এদিন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেছেন, ২২ এপ্রিলের পর থেকে এ পর্যন্ত ৪০ থেকে ৫০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছেন।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাহোরজুড়ে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ শোনা গেছে বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা। লাহোর শহরের আকাশে ড্রোন বিস্ফোরণ ও ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা এবং হঠাৎ আকাশসীমায় হামলার আশঙ্কায় কর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট জেনারেল। কনস্যুলেটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, লাহোরের প্রধান বিমানবন্দরের আশপাশের কিছু এলাকায় লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার প্রাথমিক তথ্যও তারা পেয়েছে। পাকিস্তানের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বলেছে, বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত করাচি বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে ইসলামাবাদ ও লাহোরে বিমানের উড্ডয়ন-অবতরণ সাময়িক স্থগিত রাখা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ‘অপারেশন সিঁদুর’র নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ভারতের ১৫টি শহরে অবস্থিত সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তান। তবে সেগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার দাবি করেছে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী। এই বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি পাকিস্তান। তবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে পাঞ্জাবে এবার মক ড্রিল শুরু করেছে পাকিস্তান। পাশাপাশি লাহোর, ইসলামাবাদে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে দেশটি। এরই মধ্যে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগছিকে ভারত জানিয়েছে, প্রত্যাঘাতের পর পরিস্থিতি আরও জটিল করতে আগ্রহী নয় নয়াদিল্লি। তবে পাকিস্তান সামরিক আক্রমণ করলে ভারত তার যোগ্য জবাব দেবে। বৃহস্পতিবার ইরানের সঙ্গে যৌথ কমিশনের বৈঠকে দেওয়া ভাষণে ভারতের এই মনোভাবের কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। এদিকে শুরু থেকেই যুদ্ধ নয়, আমরা শান্তি চাই বলে আসছে পাকিস্তান সরকার। অন্যদিকে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সংঘাতকে ‘ভয়াবহ’ উল্লেখ করে তা অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রয়োজনে সংঘর্ষ নিরসনে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত আছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। হোয়াইট হাউজে এক বক্তব্যে ট্রাম্প আরও বলেছেন, ‘অবস্থা সত্যিই খুব ভয়াবহ। আমি উভয় দেশকে ভালোভাবে চিনি। উভয়ের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক আছে। আমি চাই, তারা বিষয়টি মিটিয়ে নিক। আমি চাই, তারা থামুক।’মঙ্গলবারের ওই হামলায় পাকিস্তানের ৩১ জন নিহত ও ৫৭ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে, ভারত বলছে যে পাকিস্তানের পালটা গোলাবর্ষণে তাদেরও ১৫ জন বেসামরিক নিহত হয়েছেন।